গঙ্গাসাগর-সব তীর্থ বার বার গঙ্গাসাগর একবার

gk-gangasagar-গঙ্গাসাগর

গঙ্গাসাগর-সব তীর্থ বার বার গঙ্গাসাগর একবার

গঙ্গাসাগর-সব তীর্থ বার বার গঙ্গাসাগর একবার

লেখকঃ শ্রী বিশ্বজিৎ দাস

গঙ্গাসাগর মেলা দ্বিতীয় বৃহত্তম হিন্দু মেলা (কুম্ভমেলার পরে)। পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ দিকে সাগর দ্বীপের দক্ষিণ প্রান্তে যেখানে গঙ্গা নদী (হুগলি নদী) বঙ্গোপসাগরের সাথে মিলিত হয়েছে সেই স্থানকে বলা হয় গঙ্গাসাগর। যুগ যুগ ধরে পৌষ মাসের শেষে মক্রর সংক্রান্তিতে এই স্থানে অনুষ্ঠিত হয় গঙ্গাসাগর মেলা। পৌষ মাসের একেবারে শেষ মকর সংক্রান্তির দিনে কয়েক লক্ষ নরনারী প্রচণ্ড শীতের দাপট উপেক্ষা করে হাজির হয় এই সাগর সঙ্গমে। 
কবে থেকে এই মেলা শুরু তার কোন প্রামাণ্য সন তারিখ পাওয়া যায় নি। ভারতের যত প্রাচীন পুঁথি, পুরান বা গ্রন্থ রয়েছে, তার প্রায় সবেতেই এর উল্লেখ আছে। গঙ্গাসাগর মেলা ভারতের কুম্ভ মেলার পর দ্বিতীয় বৃহত্তম ও অন্যতম প্রাচীন মেলা।
গঙ্গা নদীর মর্ত্যে প্রত্যাবর্তন ও সগর রাজার পুত্রদের জীবন বিসর্জনের লোকগাঁথাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে এই বিখ্যাত তীর্থস্থান গঙ্গাসাগর।
এই দুর্গম স্নানে মহাঋষি কপিল মুনির আশ্রম ছিলো।

‘সব তীর্থ বারবার, গঙ্গাসাগর একবার’

এই তীর্থস্থানটি এক সময়ে এতোই দুর্গম স্থাণে অবস্থিত ছিলো যে অন্য তীর্থের মতো সব সময় বা ইচ্ছা মতো যাওয়া সম্ভব হতো না। নদীনালা, বন জঙ্গল অতিক্রম করে যেতে হতো। তা ছাড়া চোর, ডাকাত ও জলদস্যুর ভয় তো ছিলই এমনকি বন্য জন্তুর আক্রমনে মৃত্যুও পর্যন্ত ঘটত। তাই বলা হতো ‘সব তীর্থ বারবার, গঙ্গা সাগর একবার।’ তবে বর্তমানে সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা মেলায় প্রাথমিক চিকিৎসা থেকে আরম্ভ করে বিভিন্ন সেবামূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে থাকেন। যোগাযোগ ব্যবস্থা আগের থেকে অনেক ভালো হওয়ায় এখন সহজেই কলকাতা থেকে দিনে দিনেই গঙ্গাসাগর ঘুরে আসা যায়।

গঙ্গাসাগর মেলার অবস্থান

পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ দিকে সাগর দ্বীপের দক্ষিণ প্রান্তে যেখানে গঙ্গা নদী (হুগলি নদী) বঙ্গোপসাগরের সাথে মিলিত হয়েছে সেই স্থানকে বলা হয় গঙ্গাসাগর। আদতে গঙ্গাসাগর মেলা হলো পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণে সাগর দ্বীপের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত, কপিলমুনির আশ্রমে প্রতিবছর মকর সংক্রান্তিতে অনুষ্ঠিত একটি মেলা ও ধর্মীয় উৎসব। কলকাতা শহর থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই দ্বীপটি।

গঙ্গাসাগর কিভাবে যাওয়া যায়?

কলকাতা থেকে কাকদ্বীপের লট 8 হারউড পয়েন্টের দূরত্ব প্রায় 90 কিলোমিটার।কলকাতা থেকে সরাসরি বাস বা গাড়ি ভাড়া করে কাকদ্বীপের লট 8 হারউড পয়েন্টের জেটিতে যেতে হবে।ট্রেনে কাকদ্বীপ বা নামখানা পৌঁছেও বাসে বা রিকশায় হারউড পয়েন্ট ৮ নম্বর লঞ্চ ঘাটে পৌঁছনো যায়। সেখান থেকে ফেরি ভেসেলে গঙ্গা (মুড়িগঙ্গা) পেরিয়ে কচুবেড়িয়া।কচুবেড়িয়া থেকে সাগরের দূরত্ব 30 কিলোমিটার। এখান থেকে বাসে বা ট্রেকারে যেতে হবে। তবে মেলার সময় যাতায়াতের আরও বিশেষ ব্যবস্থা থাকে।
বড়দিনের আগেই কলকাতা থেকে গঙ্গাসাগর পর্যন্ত ফেরি সার্ভিস শুরু হয়ে যাবে। বিলাসবহুল জাহাজে কলকাতা থেকে সরাসরি পৌঁছে যাবেন গঙ্গাসাগরে। রোজ সকাল ৭ টায় মিলেনিয়াম পার্কের ঘাট থেকে এই জাহাজ ছাড়বে। সাগরের কচুবেড়িয়া ঘাটে সকাল সাড়ে ১০টার মধ্যে পৌঁছে যাবে জাহাজ।
এবার দক্ষিণ ২৪ পরগণার জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে বয়স্ক, প্রতিবন্ধী, শিশু ও মহিলাদের মোক্ষলাভের বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছে।অফলাইন ও অনলাইন দুই-এর মাধ্যমে বুক করা যাবে এই পরিষেবা। সাগর ভ্রমণের পরিষেবা শুরু হবে কলকাতার বাবুঘাট থেকে। যাত্রীদের সমগ্র গঙ্গাসাগর ভ্রমণ করিয়ে যথাস্থানে ফিরিয়ে আনবে।

গঙ্গাসাগরে থাকার ব্যবস্থা

গঙ্গাসাগরে থাকার জন্য নানান ধর্মশালা ও পান্থনিবাস আছে। এ ছাড়া পি ডব্লু ডি, সেচ দফতরের ও পাবলিক হেলথ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বাংলো ও পঞ্চায়েতের যাত্রীনিবাস আছে।

গঙ্গাসাগর স্নানের দিনক্ষন

শাহি স্নান সঠিক মুহূর্তে গঙ্গাসাগরে স্নান করলে সমস্ত অর্জিত পাপ ধ্বংস হয় এবং মোক্ষ অর্জিত হয়, একেই শাহি স্নান বলে।

সময়: ৮ই জানুয়ারি থেকে ১৭ই জানুয়ারি।

গঙ্গাসাগরে পুণ্য স্নানের সময়

জন্ম ও মৃত্যুর যে অনন্তচক্র তার থেকে মুক্তিই মোক্ষ। বলা হয়, মকরসংক্রান্তির মহালগ্নে সাগরসঙ্গমের পবিত্র জলে স্নান করলে মানুষের মোক্ষ প্রাপ্তি হয়। সেই কারণে মোক্ষ প্রাপ্তির জন্য যুগ যুগ ধরে মকর সংক্রান্তির দিন লক্ষ লক্ষ পুণ্যার্থী গঙ্গাসাগরের পবিত্র জলে স্নান করেন।
সময়: ১৫ জানুয়ারি ৯টা ১৩ মিনিটে হচ্ছে মকর সংক্রান্তি।
পুণ্যস্নানের সময় ১৫ জানুয়ারি রাত ১২টা ১৩ মিনিট থেকে ১৬ জানুয়ারি বেলা ১২টা ১৩ মিনিট পর্যন্ত।
এবছর গঙ্গাসাগরে পুণ্য স্নানের সময় ২৪ ঘন্টা
মেলায় ই-স্নানের ব্যবস্থাও থাকছে। অর্থাৎ দেশের যে কোনও প্রান্ত থেকে অনলাইনে আবেদন করা হলে, বাড়িতে পৌঁছে যাবে গঙ্গাসাগরের পবিত্র জল।

দ্বীপ ও মন্দিরের ইতিহাস এবং জনশ্রুতি

বঙ্গোপসাগরের উপকূলে সুন্দরবন অঞ্চলের এই দ্বীপটির প্রাচীন নাম শ্বেতদ্বীপ। যুগ যুগ ধরে পৌষ মাসের শেষে মক্রর সংক্রান্তিতে এই স্থানে অনুষ্ঠিত হয় গঙ্গাসাগর মেলা। এক কালে সাগর দ্বীপ ছিলো ১৭০ বর্গ মাইলের এক সমৃদ্ধ জনপথ। ১৬৮৮ সালে সামুদ্রিক ঝড় ও জলচছাসে প্রায় দু লক্ষ মানুষ সমুদ্রে ভেসে যায়। সেই থেকে দ্বীপটি বহুকাল জনহীন হয়ে পড়ে।
জনশ্রুতি অনুযায়ী মূল কপিলমুনির আশ্রম সমুদ্র গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ৪৩০ খ্রিস্টাব্দে রানী সত্যভামা প্রথম কপিল মুনির মন্দিরটি তৈরী করেন। সেই মন্দিরটি সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যাবার পর আরও ছয়টি মন্দির তৈরী হয় যা পরে বিলীন হয়ে যায়। তারপরে নতুনভাবে বর্তমান মন্দিরটি আদি মন্দির স্থল থেকে প্রায় ২ কিমি দূরে স্থাপন করা হয়েছে এবং এটিও বহু প্রাচীন, বহুবার সংস্কার করা হয়েছে।।
রামায়ন, বালকান্ড, ৪৩ অধ্যায় মহাভারতের বনপর্বে, পালবংশের রাজা দেবপালের একটি লিপিতে তার গঙ্গাসাগর সঙ্গমে ধর্মানুষ্ঠান করার কথা উল্লেখ আছে।

ভারতীয় বৈদিক সংস্কৃতি ও সাহিত্যে গঙ্গাসাগরের মাহাত্ম

ভারতীয় বৈদিক সংস্কৃতি ও সাহিত্যে গঙ্গাসাগর সঙ্গম বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ মহাতীর্থ। অতি প্রাচীন কাল থেকেই আধ্যাত্মিক পথের সাধক, মুনি ঋষি, সাধুসন্তু গন গঙ্গার তটভূমিতে আশ্রয় নিয়ে তারা তাদের পরম প্রাপ্তি লাভ করেছেন। গঙ্গাতীরে যাগ -যজ্ঞ, শাস্ত্র পাঠ, দান, তপস্যা, জপ, শ্রাদ্ধকৃত্য বা দেবতা পূজন করলে তা কোটিগুণ ফল প্রদান করে। বিশ্বাস করা হয় যে এই দিনে গঙ্গাসাগরে স্নান করলে ১০০টি অশ্বমেধ যজ্ঞের সমান পুণ্য পাওয়া যায়। মহর্ষি কপিলমুনির সাধনার পাদপীঠ এই গঙ্গাসাগর সঙ্গম। গঙ্গাসাগর সঙ্গম মহা তীর্থ। একবার বা একদিনের জন্য নয়, গঙ্গাসাগর সঙ্গম নিত্য মহা তীর্থ।

গঙ্গাসাগর স্নানের পৌরাণিক মাহাত্ম্য

সব তীর্থ বার বার গঙ্গাসাগর একবার । পৌষ সংক্রান্তি তিথির পুন্য লগ্নে পবিত্র সাগর তীর্থে মহাস্নানে ভারতবর্ষের সুপ্রাচীন অতিলৌকিক সনাতন সংস্কৃতি পূর্ণতা লাভ করেছে আবহমান কাল ধরে।
ব্রহ্মপুরান , বিষ্ণুপুরান, শ্রীমদ্ভগবদগীতা ইত্যাদি আদি গ্রন্থে গঙ্গা মাহাত্ম্য এবং গঙ্গাসাগরের উৎপত্তি বর্নিত হয়েছে। স্বসাগর পৃথিবীর অধীশ্বর সূর্য বংশীয় মহারাজা সগরের উপাখ্যান এর মূল উপজীব্য। ষাটহাজার পুত্রের জনক মহারাজা সগর উদ্যোগী হয়েছিলেন অশ্বমেধ যজ্ঞের যা তৎকালীন প্রেক্ষাপটে অতিমানবীয় ক্রিয়ার প্রতীক, তিনি একে একে নিরানব্বইটি যজ্ঞ সম্পন্ন করেন কিন্তু শততম যজ্ঞ সম্পন্নকালে বাধা সৃষ্টি করেন দেবরাজ ইন্দ্র, কারন শততম অশ্বমেধ যজ্ঞের শাস্ত্র মতে অর্থ ইন্দ্র পদ লাভ, যা স্বয়ং দেবরাজের গৌরবকে ভুলুন্ঠিত করতে যথেষ্ট ছিল এবং তার ভয়ও ছিল যে স্বর্গে তার একচ্ছত্র আধিপত্য না শেষ হয়ে যায়। ফলে ইর্ষান্বিত দেবরাজ ইন্দ্র যজ্ঞনুষ্ঠান পন্ড করতে শততম যজ্ঞের মন্ত্রপূত অশ্ব গোপনে কপিল মুনির আশ্রমে লুকিয়ে রাখেন।
কপিলমুনি দেবধি নন্দন, মহর্ষি কর্দন এবং ভগবান মনুর কন্যা বিভূতির সন্তান। তিনি ছিলেন ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারী ও মহাজ্ঞানী, তার সাংখ্য দর্শন জগদ্বিখ্যাত। তিনি এই সাগরদ্বীপে নিজ আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যেখানে ইন্দ্র চক্রান্ত করে অশ্বমেধ যজ্ঞের অশ্ব লুকিয়ে রাখেন।

গঙ্গাসাগর স্নানের পৌরাণিক মাহাত্ম্য

মহারাজা সগর যখন জানতে পারলেন যে তার অশ্ব নিরুদ্দেশ, তিনি তখন তার ষাট হাজার পুত্রকে প্রেরন করলেন। বহু অন্বেষন শেষে কপিলমুনির আশ্রমে খুঁজে পাওয়া যায় অশ্বমেধের ঘোড়া 🐎। কিন্তু নিয়তি হয়তো কিছু আলাদাই বিধি রচনা করেছিল। সগর পুত্রদের মনে হলো এই সাধুই অশ্বমেধের ঘোড়া চুরি করবার দুঃসাহস দেখিয়েছে। যে ঘটনার বিন্দু বিসর্গ জানতেন না মহামুনি। ফলে বহু মিথ্যা অভিযোগে, অপমানে, লাঞ্ছনায় কটু কথায় জর্জরিত করা হয় কপিলমুনিকে । সহ্যের সীমা অতিক্রম করতে থাকায় ভগবান কপিল দেব ভয়াবহ রোষানলে মহারাজা সগরের ষাট হাজার পুত্রকে ভষ্মিভূত অঙ্গারে পরিনত করেন।
এদিকে ঘটনায় ব্যাথিত মহারাজা সগর জীবিত অন্যতম পুত্র অসামঞ্জস্য এবং তার পুত্র অংশুমানকে পাঠালেন ঘটনাস্থলে। নিদারুণ ব্যাথিত হৃদয়ে ভগবান কপিলমুনির নিকট ষাট হাজার পুত্রের জীবন ভিক্ষা করলে অসমর্থতা প্রকাশ করেন ভগবান কপিলমুনি এবং এর নিরসনে একমাত্র উপায় প্রদান করেন যে একমাত্র শ্রী শ্রী নারায়নের আরাধনায় পরম মোক্ষদায়িনী গঙ্গার পবিত্র সলিলসুধার স্পর্শে জীবন ফিরে পাবে ষাট হাজার সগর সন্তান।

গঙ্গাসাগর স্নানের পৌরাণিক মাহাত্ম্য

নির্দেশ মতো মহারাজা সগর এবং অংশুমান ক্রমান্বয়ে কঠোর তপস্যায় রত হলেন, কিন্তু উদ্দেশ্যে সিদ্ধ হলো না। শেষে মহারাজা সগর সূর্য বংশীয় অন্যতম মহান নৃপতি পরম বৈষ্ণব এবং শ্রীকৃষ্ণের পরম ভক্ত মহারাজা ভগীরথের স্মরনাপন্ন হলেন। মহারাজা ভগীরথ মর্তে গঙ্গা আনায়নের জন্য কঠোর সাধনায় লীন হলেন। অপরিসীম ধৈর্য্যে কঠোর তপশ্চর্য্য শেষে শ্রী শ্রী ভগবানের হৃদয় বিগলিত হলো। শ্রী শ্রী ভগবান স্বয়ং গঙ্গা দেবীকে নিয়ে ভগীরথের নিকট উপস্থিত হলেন। ভগীরথের নিকট সমস্ত ঘটনার বিবরণ শুনলেন শ্রী শ্রী মধুসূদন কিন্তু বাধ সাধলেন দেবী গঙ্গা। গঙ্গা দেবী নিজের পবিত্র সলিলসুধায় মর্তের পাপ নিতে রাজি হলেন না। ভগবান আশ্বস্ত করলেন, বললেন যে মর্তের সমস্ত পাপ তোমার সলিলে সমাহিত হলেও পরম ভক্ত ভগীরথের অবগাহনে তা পবিত্রই থাকবে। গঙ্গা রাজি হলেও অপর সমস্যা ছিল তার প্রবল জলধারা, যা ত্রিভুবন প্লাবিত করার জন্য সক্ষম এবং মর্তে আগমনে তা প্রলয় ঘটাবে। কিন্তু এখানেও কল্পতরু হলেন দেবাদিদেব মহাদেব, তিনি নিজের জটায় ধারন করলেন গঙ্গার তীব্র জলধারা। জটা সিঞ্চিত গঙ্গা এরপর ভগীরথের পথ অনুসরণ করলেন। পবিত্র শঙ্খধ্বনিতে ভগীরথের পশ্চাতে ধাবিত হলো গঙ্গা। ত্রিভুবনে মঙ্গলধ্বনি ধ্বনিত হলো।
পবিত্র গঙ্গাজলের স্পর্শে সগর সন্তানেরা মুক্ত হলেন ।

বৈতরণী পার

গরুড় পুরাণের ৪৭তম অধ্যায়ে বৈতরণী নদীর নাম পাওয়া যায়। এই নদী জীবজগৎ ও মরজগতের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করে। গরুর লেজ ধরে এই নদী পার হওয়া যায়। পুরাণ অনুযায়ী মৃতের আত্মারা এই বৈতরণী নদী পার করেই স্বর্গে পৌঁছন আর যারা এই নদী পেরোতে পারেন না তাদের আত্মা নরকের অতল গহ্বরে পতিত হয়। কিন্তু সেইসব অসহায় আত্মা গরুর লেজ ধরে এই নদী পার হতে পারে। সেইকারণে মকর সংক্রান্তির দিন, অসংখ্য মানুষ সাগর পাড়ে ভিড় করেন গরুর লেজ ধরে ‘বৈতরণী পার’ আচার পালন করবার জন্য। 

গঙ্গাসাগরের মূল আকর্ষণ – কপিলমুনির মন্দির

গঙ্গাসাগর মেলার মূল আকর্ষণ কপিলমুনির মন্দির। শ্রী মন্দিরে কপিল দেব পদ্মাসনে যোগারূঢ় অবস্থায় উপবিষ্ট। তার বাম হাতে কমন্ডুল, ডান হাতে জপমালা, শিরোদেশে পঞ্চনাগ ছত্রবৎ অবস্থিত। শ্রী কপিল দেবের বিগ্রহের দক্ষিনে শ্রী গঙ্গাদেবীর বিগ্রহ। ইনি চতুর্ভুজা এবং মকর বাহন। শ্রী হস্ত সমূহে শঙ্খ, পদ্ম, অমৃত কুম্ভ ও বরাভয়। সম্মুখে মহাতাপস ভগীরথ। কপিল দেবের বিগ্রহের বামদিকে সগর রাজা ভক্তি বিনম্র চিত্তে করজোড়ে অবস্থানরত। এখানে আছে ভগীরথের কোলে মা গঙ্গা, বীর হনুমান, সিংহবাহিনী, বিশালক্ষী ও ইন্দ্রদেব। এই গঙ্গাসাগর সঙ্গমে মকর সংক্রান্তি উপলক্ষে কয়েক লক্ষ পূন্যার্থী মহা স্নান করেন।

গঙ্গাসাগরের বিশেষ আকর্ষণ – হিমালয়ের সাধু সন্তু নাগা সন্ন্যাসী

পরমার্থের টানে এক তীর্থ থেকে আরেক তীর্থে ছুটে চলা। সাধক জীবনে এটাই দস্তুর। পুণ্য অর্জনের আশায় রাজ্যের পাশাপাশি অন্যান্য জায়গা থেকেও সাধু-সন্তরা আসেন কপিল মুনির আশ্রম চত্বরে। হিমালয়ের সাধু সন্তু এই মেলার বিশেষ আকর্ষণ। আসেন নাগা সন্ন্যাসীরাও। তীব্র শীত উপেক্ষা করে কেবল ছাই ভষ্ম মেখে অনাবৃত অবস্থায় তাঁরা তাঁদের ধর্মীয় নিয়ম পালন করে আসছেন। নাগা সাধুরা কপিল মুনির মন্দিরের পাশের ডেরাতে জমিয়ে বসে ভক্তদের দর্শন দেন। ভেসে আসে গাঁজা, ধূপ, ধুনোর পরিচিত সেই গন্ধ। সাধারণ পুণ্যার্থীরা কপিল মুনির মন্দিরে পুজো দেওয়ার পর নাগাদের আখড়ায় প্রণাম ঠুকে যান। আগামী কয়েক দিন নাগাদের এই ডেরা হয়ে উঠবে পুণ্যার্থীদের অন্যতম গন্তব্য। বাবুঘাট থেকে ডায়মন্ড হারবার হয়ে হারউড পয়েন্ট পর্যন্ত গঙ্গাসাগর লেখা বাসগুলিতে চোখ পড়লেই দেখা মিলবে সেই পুণ্যার্থীদের। শুধুমাত্র পুণ্য অর্জনে। এ এক সুপ্রাচীন পরম্পরা।

মকর সংক্রান্তি কি?

সংক্রান্তির অর্থ গমন করা। সূর্য এদিন নিজের কক্ষপথ থেকে মকর রাশিতে প্রবেশ বা সংক্রমিত হয়। তাই এই দিনটিকে মকর সংক্রান্তি বলা হয়। বলা হয়, সংক্রান্তি দেবী নাকি এই দিনই শঙ্করাসুর নামের দানবকে বধ করেন। সূর্য এদিন মকর রাশিতে গমন করে বলে, এই দিনটিকে শুভ বলে ধরা হয়। ১২ টি রাশির এরকম মোট ১২ টি সংক্রান্তি আছে।

Utube_comptech_home
দশম শ্রেণীর ভৌত বিজ্ঞান এবং জীবন বিজ্ঞানের বিভিন্ন অধ্যায়ের উপর ভিডিও টিউটোরিয়াল পেতে আমাদের You Tube চ্যানেল ফলো করুন

মকর সংক্রান্তিতে বাঙালীর বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান

এই দিনে বাঙালীরা বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। তার মধ্যে পিঠে তৈরী করে খাওয়া ও ঘুড়ি ওড়ানো অন্যতম। আগেকার দিনে পটকা ফুটিয়ে বা ফানুস উড়িয়ে উদযাপন করা হতো। বীরভূম জেলার কেন্দুলী গ্রামে ঐতিহ্যমন্ডিত জয়দেবের মেলা এই দিনেই অনুষ্ঠিত হয়।

পঞ্চরত্ন ও সূতা প্রদান গঙ্গাসাগরের অপর একটি ধর্মীয আচার হল, পঞ্চরত্ন ও সূতা প্রদান। এই প্রথা অনুযায়ী, পঞ্চরত্ন ও পবিত্র সূতা নদীর খাতে ভাসানো হয়, যা নদীর স্রোতে সমুদ্রে গিয়ে মেশে। এই সম্পূর্ন প্রথাটি ত্যাগের প্রতীক।

দেশভেদে মকর সংক্রান্তিতে পালিত বিভিন্ন লোকউৎসব

এই দিন ভারতের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশে নানাভাবে উদযাপিত হয়। নেপালে এই দিবস মাঘি নামে, থাইল্যান্ডে সংক্রান, লাওসে পি মা লাও, মিয়ানমারে থিং ইয়ান ও কম্বোডিয়ায় মহাসংক্রান নামে উদযাপিত হয়। দেশ ভেদে এর নামের সাথে উৎসবের ধরনের পার্থক্য থাকলেও উপলক্ষ্য কিন্তু এক।

গঙ্গার প্রণাম মন্ত্র

গঙ্গাসাগর জাতপাত ভুলে, সমস্ত সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে ঐক্যের এক ভারতের সূচনার আঁতুড়ঘর।
সর্ব্বং কৃতযুগে পুণ্যং, ত্রেতায়াং পুষ্করং স্মৃতম।
দ্বাপরে তু কুরুক্ষেত্রং গঙ্গা কলিযুগে স্মৃতা।।
গঙ্গার প্রণাম মন্ত্র
সদ্যঃ পাতকসংহন্ত্রী সদ্যোদুঃখবিনাশিনী।
সুখদা মোক্ষদা গঙ্গা গঙ্গৈব পরমা গতিঃ।।
অর্থঃ যিনি তত্ক্ষণাৎ পাপ হরণ করেন, দুঃখ বিনাশ করেন, সুখদাত্রী মোক্ষদাত্রী গঙ্গা, সেই গঙ্গাই আমার পরম গতি।

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!